দেশভাগ্ সম্পর্কিত কয়েকটি বই
বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
হাসান আজিজুল হক; আগুনপাখি (কলকাতা: দে'জ পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা, ২০০৮);
ত্রিদিব চক্রবর্তী, নিরুপমা রায় মন্ডল, পৌলোমী ঘোষাল সম্পা: ধ্বংস ও নির্মাণ: বঙ্গীয় উদ্বাস্তু সমাজের স্বকথিত বিবরণ (কলকাতা: সেরিবান, স্কুল অব কালচারাল টেক্সট্স্ অ্যান্ড রেকর্ডস্, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা, ২০০৭)
সেমন্তী ঘোষ সম্পা: দেশভাগ: স্মৃতি আর স্তব্ধতা (কলকাতা: গাঙচিল, প্রথম প্রকাশঃ কলকাতা, ২০০৮)
"আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়৷ আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর যায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে৷ আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ৷ খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ"৷-আগুনপাখি, হাসান আজিজুল হক
দেজ পাবলিশিং প্রকাশিত উপন্যাসটির পিছনের প্রচ্ছদে এই কয়টি লাইন উদ্ধৃত৷ লাইনগুলি উপন্যাসটির মূল মোটিফের সার্থক ধরতাই যোগায়৷ হাসান আজিজুল হকের মত শক্তিশালী কাহিনীকারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস হিসেবে "আগুনপাখি" অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ৷ অনেকের কাছে হয়ত বা আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তি উপন্যাসটিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দান করে৷ কিন্তু আপাতত: আমি ঐ লাইন কটির পিছনে একটি উপমহাদেশ এবং তার অগুন্তি সাধারণ মানুষের ইতিহাসের সিল্যুয়েট ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না৷হয় তো আরও অনেক কিছুই দেখা সম্ভব৷ একজন মুসলমান নারীর গার্হস্থ্য আত্মকথন চলতি যুগের অ্যাকাডেমিক ফ্যাশনের নিরিখে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের সম্ভাবনায় উজ্জ্বল৷ উপন্যাসটির সরলরৈখিক আটপৌরে চলন কি ইচ্ছাকৃত একটি শৈলী, যা দেশভাগের বিয়োগান্ত মহাকাব্যের একটি সমান্তরাল নারীবাদী ভাষ্যের জন্ম দেয়? অথবা, বন্যা ও মন্বন্তরের পরে যৌথ পরিবারের ভাঙন কি পরবর্তী সময়ের আরও বড় ভাঙনের রূপকাভাস? প্রশ্নগুলি এই মুহূর্তে আমি এড়াতে চাই৷ বস্তুত: উপন্যাসটির প্রথাগত সমালোচনা আদৌ এ লেখাটির উদ্দেশ্য নয়৷ হাসান আজিজুল হলের মত প্রবাদপ্রতিম কাহিনীকারের সৃষ্টির ভালোমন্দ বিচারের স্পর্ধা বা সামর্থ্য -কোনোটাই অর্জন করি নি এখনও৷ উপন্যাসটির গপ্পোটি জেনে নেওয়ার দায়িত্বটাও পাঠকপাঠিকার উপরই ন্যস্ত করি৷ বরং ঐ কম্পাসপ্রতিম বাক্যগুলি বুকপকেটে রেখে কিছু এলোমেলো ভাবনার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি৷
"Forgetting, I would even go so far as to say historical error, is a crucial factor in the creation of a nation, which is why progress in historical studies often constitutes a danger for [the principle of] nationality"- What is a Nation, Ernst Renan
দেশভাগের ইতিহাস মূলত: স্বেচ্ছাশ্রিত বিস্মৃতির ইতিহাস৷ দেশভাগ নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি বইয়ের সম্পাদক এই বিষয়ে সহমত৷ প্রথম বইটি "ধংস ও নির্মাণ: বঙ্গীয় উদ্বাস্তু সমাজের স্বকথিত বিবরণ"৷ প্রকাশ করেছেন সেরিবান, গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ কালচারাল টেক্স্ট অ্যান্ড রেকর্ডসের ত্রিদিব চক্রবর্তী, নিরুপমা রায় মন্ডল ও পৌলোমী ঘোষাল৷দ্বিতীয় বইটি সেমন্তী ঘোষ সম্পাদিত "দেশভাগ: স্মৃতি আর স্তব্ধতা", প্রকাশনায় গাঙচিল৷ প্রথম বইটির সম্পাদকরা ভূমিকায় বলছেন- "সামগ্রিকভাবে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু জীবন আমাদের ইতিহাসচর্চা ও সমাজবিশ্লেষণে বিস্ময়করভাবে অবহেলিত৷" দ্বিতীয় বইটির সম্পাদিকার জবানে- "ইতিহাস লেখালেখির জগতে দেশভাগের ঘটনাটির একটা বড় জায়গা দখল করার কথা থাকলেও, বাস্তবে তেমনটা হয়ে ওঠে নি৷"
এই বিস্মৃতির আঞ্চলিক প্রভেদ আছে৷ উপমহ দেশের পশ্চিমাংশের দেশভাগের ইতিহাস পূর্বাংশের ইতিহাসের থেকে অনেক বেশি চর্চিত৷ আবার পূর্বাংশের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগের ইতিহাসের চর্চা ও রোমন্থনের ব্যাপ্তি বাংলাদেশের থেকে অনেক বেশি৷ সেমন্তী সম্পাদিত বইটির একটি প্রবন্ধে আনিসুজ্জামান জানাচ্ছেন- স্বাধীনত লাভের পঞ্চাশ বা ষাট বছরপূর্তি ভারতে বা পাকিস্তানে যেভাবে পালিত হয়েছে, সেই উদ্দীপনার সামান্যাংশও বাংলাদেশে দেখা যায় নি৷ আনিসুজ্জামানের উত্কন্ঠিত প্রশ্ন "তবে কি ভারতীয় উপমহাদেশের সামগ্রিক ইতিহাস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছি আমরা? " ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনানুসারে ইতিহাসের নিজস্ব কোলাজ তৈরি করে নেয় ও নেবেই৷ বিশেষ সেই প্রয়োজনের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক, যাবতীয় ঐক্যকল্পনার আবেগ সত্ত্বেও৷ বাংলাদেশের মানুষের ক ছে ১৯৪৭ শুধু স্বাধীনতা ও দেশভাগের কালচিহ্ন নয়, নিজস্ব রাষ্ট্রপ্রাপ্তির প্রথম পদক্ষেপও বটে৷ বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে নবীন জাতিরাষ্ট্র নির্মিতির উপকরণ হিসেবে ১৯৪৭-এর থেকে ১৯৭১-এর গুরুত্বও বেশি৷ এই বিস্মৃতির পটভূমিকায় "আগুনপাখি" একটি বিরল প্রাপ্তি৷
সেমন্তী বইটির মুখবন্ধে খুব সংক্ষেপে বিস্মৃতির কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করেছেন৷ তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গে বামরাজনীতির ক্রমবৃ দ্ধি৷ এই বইটির অন্য একটি প্রবন্ধে মৈনাক বিশ্বাস সমস্যাটিকে দেখেছেন একটু অন্যভাবে- সামূহিক ট্রমার নিরাময়ের দৃষ্টিভঙ্গীতে৷ মৈনাকের মতে- "আমাদের দেশভাগের কথা হয়তো আমরা বলিনি তা নয়, বলেছি ট্রমাগ্রস্তের মতো, সরে সরে, স্থানচ্যুতির মধ্যে দিয়ে৷" কে আর হদৃয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! ভুলে-থাকতে-চাওয়ার মনস্তত্ত্বের বহু কাহিনী উর্বশী বুতালিয়া লিখেছিলেন তাঁর "Other side of Silence" বইটিতে৷ দেশভাগের সময় ট্রমার উত্সমুখ শুধু ঘরের বাইরেই ছিল না, ঘরের মধ্যেও ছিল৷ সেই সময় নারীদের ইজ্জতরক্ষা পুরুষের একট বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ অতএব "ওদের" হাতে অনেকের জাত না গেলেও, প্রাণ গিয়েছিল পিতা-পুত্র-ভ্রাতার হাতে৷ এই প্রাণনাশ হত্যা এবং আত্মহত্যার মধ্যবর্তী এক ধূসরসীমানার অন্তর্গত৷ আপাতত: যখন শান্তিকল্যাণ, সেই রক্তের দাগ কে আর ফিরে দেখতে চায়?
সামাজিক ও জাতিগত স্তরে এই বিস্মৃতি মনে হয় না বাঙালীচরিত্রের কোনো অনড় ভ্রান্তি, যদিও এই ব্যপারে বঙ্কিমের খেদ এখনও বহুল উদ্ধৃত৷গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত "নিম্নবর্গের ইতিহাস" বইটির অন্তর্ভুক্ত "ইতিহাসের উত্তরাধিকার" প্রবন্ধে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন যে "বাঙালীর ইতিহাস নাই"- এই বঙ্কিমী ক্ষোভের কারণ ইতিহাসের অভাব নয়, একটি বিশেষ আদলের ইতিহাসের অভাব৷ এই বিশেষ আদলের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস জায়মান জাতিরাষ্ট্রের সফল প্রসবের ধাত্রী৷ এই ইতিহাস নির্মিতির তাগিদে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে জন্মদাগ লুকাতে হয়৷ নইলে কোনো জাতির নিটোল ইতিহাস তৈরি হয় না৷ দাঙ্গা, গণহত্যা ও দেশভাগের কলঙ্ককে সাময়িক ভুল অথবা তৃতীয় পক্ষের চক্রান্তের আড়ালে ঢেকে ফেলতে পারলে ইতিহাস জাতির কাছে অনেক সহজপাচ্য হয়ে ওঠে, যদিও আমরাই প্রতিবেশীকে মেরেছি, এবং আমরাই প্রতিবেশিনীকে ধর্ষণ করেছি৷ গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত "নিম্নবর্গের ইতিহাস" বইটিতে জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে তাঁর "ভগ্নাংশের সমর্থনে: দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়" প্রবন্ধটিতে এই ভাবনার রসদ যোগান৷ জ্ঞানেন্দ্র বলেন- "সচেতনভাবে হোক বা না-হোক, দেশভাগ একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবেই রূপায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৭-এর ১৪ অগাস্ট যেদিন পাকিস্তানের জন্ম হল- সেটি একটি অঘটন, "ভুল", যার জন্য দায়ী আমরা নই, অন্য কেউ"৷
"-দেশভাগের চার-পাঁচ বছর আগে আপনাদের গ্রামে পরিবারগুলির মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল?
- গ্রামের পরিবারগুলির মধ্যে সম্পর্ক খুবই ভাল ছিল৷ বিশেষ করে, বিভিন্ন পার্বণে যখন আমাদের গ্রামে মেলা হত৷"- একটি সাক্ষাত্কারের অংশ, ধ্বংস ও নির্মাণ
তবু সময়ের দাবীতে স্মৃতির ভার হালকা হয়৷ দেশভাগের পঞ্চাশ বছর পরে আস্তে আস্তে পিছনে ফিরে দেখার আয়োজন শুরু হয়েছে৷আর্কাইভের দলিল দিয়ে সাজানো উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক কূটকচালির ইতিহাস ততটা অপ্রতুল ছিল না৷ বরং হারিয়ে যেতে পারত সাধারণ মানুষের দেশভাগের ইতিহাস৷ সেই হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রুখতে অনেকেই সেই সময়ের স্মৃতির পুনরুদ্ধারের কাজে হাত দিয়েছেন৷ সেমন্তী সম্পাদিত বইটি আংশিকভাবে সেই উদ্দেশ্য পূরণ করে৷ সেরিবান ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বইটি সম্পূর্ণভাবেই এই স্মৃতি ধরে রাখার একটি প্রয়াস৷ বস্তুত: "আগুনপাখি"ও তার উপন্যাস-চরিত্র সত্ত্বেও এক বিশেষ সময়ের স্মৃতিকে ধারণ করে৷ কিন্তু স্মৃতি তো ইতিহাস নয়৷ "দেশভাগ : স্মৃতি আর স্তব্ধতা" বইটিতে স্মৃতি ও ইতিহাসের এই জটিল সম্পর্ক বিষয়ে দীপেশ চক্রবর্তীর একটি অবশ্যপাঠ্য ইংরাজি প্রবন্ধের অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৷ প্রবন্ধটির নাম "বাস্তুহারার স্মৃতি ও সংস্কার : ছেড়ে আসা গ্রাম"৷ দীপেশবাবু দক্ষিণারঞ্জন বসু সম্পাদিত 'ছেড়ে আসা গ্রাম' নামে একটি পুরানো বইয়ের বিভিন্ন স্মৃতিকথাকে কেন্দ্র করে তাঁর প্রবন্ধটিকে সাজান৷ দীপেশবাবুর আলোচ্য স্মৃতিকথার লেখকরা সবাই হিন্দু৷ 'আগুনপাখি' একজন অর্ধশিক্ষিত মুসলমান গৃহস্থনারীর আত্মকথা৷ 'ধ্বংস ও নির্মাণ' বইটিতে এক মিশ্রজনগোষ্ঠীর সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছে- হিন্দু-মুসলমান মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত অর্ধশিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত মিলিয়ে মিশিয়ে৷ অর্থাত্ এঁদের অবস্থান দেশভাগের ইতিহাসের বিভিন্ন কোণে ও বিভিন্ন স্তরে৷ অথচ বিবিধ চরিত্রের টেক্সটের মধ্যেও একটি মিল সুস্পষ্ট৷ এই মিলটি, দীপেশবাবুর ভাষায় 'একটা স্তম্ভিত অবিশ্বাস'৷ একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়া যাক- 'যে জায়গাটাকে তাঁরা তাঁদের দেশ বলে বর্ণনা করছেন,সেখানে এমন কিছুই ঘটে নি যার ফলে এমন প্রবল জাতিদ্বেষ তৈরি হতে পরে৷ কিছুই ঘটে নি যার ফলে তাঁরা সেই জাতিদ্বেষের স্বীকার হতে পারেন৷ বরং দেশভাগের মতো একটা ঘটনা যে আদৌ ঘটে গেল, এতগুলো লোক এমন আচমকা, এমন নির্মম ভাবে এবং সর্বোপরি এমন আমূল ভাবে ছোটবেলার ভিটে থেকে উত্খাত হলেন, সে সব ব্যপারেই একটা স্তম্ভিত অবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে লেখাগুলির প্রতিটি ছত্রে৷'
এই স্মৃতিকথা বা সাক্ষাত্কারে হিন্দু-মুসলমানের ছোঁয়াছুঁয়ির কথা আছে, উচ্চবর্ণ হিন্দু ও নিম্নবর্ণ হিন্দুর বাছবিচারের কথা আছে, কিন্তু জাতিদ্বেষ এবং প্রত্যক্ষ হিংসার কথা আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত৷ 'ধ্বংস ও নির্মাণ' বইটিতে অজস্র সাক্ষাত্কারের মধ্যে স্রেফ একটিতে প্রত্যক্ষ হিংসারর সাক্ষ্য পাওয় যায়৷ নইলে প্রায় প্রত্যেক বক্তব্যে সেই একই সুর খেলা করে- এই তো সুখে ছিলাম, কিন্তু কোথা হইতে কি হইয়া গেল৷ অথচ ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে "কোথা হইতে কি হয় নাই"৷ ইংরাজ সরকার-মুসলিম লিগ-কংগ্রেসের দুষ্টু লোকের ভাগ-বাঁটোয়ারার চক্রান্ত জনসমর্থনের যথেষ্ট অক্সিজেন পেয়েছিল৷ 'ধ্বংস ও নির্মাণ' বইটিতে যাঁরা সাক্ষাত্কার দিয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগ মানুষ আত্মপরিচয়, অর্থাত্ জাত ধর্ম কৌম নিয়ে যথেষ্ট সচেতন৷আত্মপরিচয়ের এই ব্যক্তিগত ধারণা এবং উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিতে কৌমভিত্তিক কূটকচালির এক উভমুখী সম্পর্ক রয়েছে৷ এই উভমুখী রসায়নের নিজস্ব প্রক্রিয়া যখন আমাদের অর্ধ-প্রত্যাশিত ট্রমার সামনে দাঁড় করায়, তখন আমরা ব্যক্তিগত দায় অস্বীকার করি৷ কিন্তু স্মৃতিকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারি না৷ অতএব স্মৃতিকে নিজের মত করে সাজাই৷ একেই মৈনাক বলেছেন 'সরে সরে কথা বলা'৷ একেই দীপেশবাবু বলেন 'ব্যাখ্যাতীত-এর বোধ' যা ট্রমাকে প্রশমিত করে৷'
'সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পুবদিকে মুখ করে বসব৷ সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি৷আমি একা৷ তা হোক, সবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি৷একা'৷- আগুনপাখি, হাসান আজিজুল হক
এইভাবে উপন্যাসটি শেষ হয়৷ দেশভাগের পটভূমিতে সংখ্যালঘু নারীর আত্মকথনের সব টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে এসে এখানে উপন্যাসটি এক গভীর ব্যক্তিগত প্রত্যয়ে সুস্থিত৷ একক এই নারী স্বামী-সন্তানের দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের শরিক হতে পারে না, নিজের দেশ না ছাড়ার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে সে অনড়৷ এই দীর্ঘ পথ চলার পর তার যন্ত্রণাদীর্ণ অথচ আলোকিত উচ্চারণ - " আমি একা "৷ আত্মপরিচয়ের মেকী নির্মোক খুলে ফেলার সাময়িক যন্ত্রণা সত্ত্বেও সে ব্যক্তিগত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এককত্বে দৃপ্ত৷ এই বোধ কোনো অবসন্ন সন্ন্যাস নয়৷ এই বোধ বহন করলে "সবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি"৷
দেশভাগের "সরে সরে যাওয়া-এড়িয়ে যাওয়া-ভুলে যাওয়ার" চালু সামাজিক ন্যারেটিভ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের আমূল একাকিত্বকে পুনর্স্থাপন করার প্রয়োজন ছিল৷ খুব সহজেই আমরা ভুলে যাই দেশভাগ বস্তুত: এই উপমহাদেশে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির প্রথম সফল পদক্ষেপ৷ সহজেই ভুলি আমাদের আত্মপরিচয়ের অসংখ্য মাত্র এবং একটি বিশেষ মাত্রাকে কেন্দ্র করে পৃথগত্ব প্রমাণের তাগিদে মেতে উঠি৷ কৌমপরিচয়ের এই সামাজিক বিশিষ্টতাই আমাদের উপমহাদেশের পুনরাবৃত্ত ইতিহাস - প্রথমবার ট্র্যাজেডি এবং তারপর প্রতিবার অর্থহীন ফার্স৷
অন্যান্য যে বইয়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্য নেওয়া হয়েছে:
গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত; নিম্নবর্গের ইতিহাস(কলকাতা: আনন্দ, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা, ১৯৯৮);
Urvashi Butalia; The Other Side of Silence:Voices from the Partition of India (Delhi:Penguin, First Published: Delhi, 1998);
Eric Hobsbawm; On History (London: Abacus; First Published: London, 1997);
'আগুনপাখি' অবশ্যই একটা ব্যতিক্রমী বই, অসাধারণ বই৷ 'আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ৷ খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ' -- এত সাহসী ও স্পষ্ট উচ্চারণ খুউউউব কম শুনেছি৷ প্রায় শুনিনি বললেই ঠিক হয়৷ এই মুহূর্তে আর একটাই উদাহরণ মনে পড়ছে 'প্রথম প্রতিশ্রুতি'র সত্যবতী৷
ReplyDelete'দেশবিভাগ' যে দুষ্টু ইংরেজের হঠাত্ বাইরে থেকে টপকে দেওয়া পেটো নয়, বরং দীর্ঘকাল ধরে এই বিভাজনের বীজে জলসিঞ্চন করেছে আমাদেরই পূর্বপুরুষ, এই সত্য কিন্তু খুব কম প্রকাশ পায়৷ যদি 'বিষাদবৃক্ষ' ধরি, তাতেও ঐ সব 'দুষ্টু ওরা'ই এরকম করালো --- এরকমই একটা সুর৷
আমার আত্মীয়স্বজনদের মুখেও মোটামুটি এরকমই শুনেছি৷
মৈনাক যাকে বলেছেন 'সরে সরে কথা বলা', তার থেকে অনেকটাই অন্যরকম আর একটা আশ্চর্য্য বই হল 'দয়াময়ীর কথা'৷ এইখানে আট ন'বছরের বালিকা দয়া দিব্বি লিখে দেয় তার সিরাজদার কথা :- 'তবে মা'কে সিরাজদা একটা কথা বলত, 'তোমরাও পিসিমা কম না৷ এতকাল তোমাগো লগে আমাগো সম্পক্ক, তাও তোমারে ছুইলে তোমার জাত যায়৷ দয়া একটা ছুট পোনাই, অরে কারো লগে মিলবার দেও না৷ তোমাগো ঘরবাড়ি পুড়ল, দ্যাশ ছাড়ত্যাছ, কিন্তু জ্যাদটা ঠিক পুইষ্যা রাখছ৷' এ বস্তু কিন্তু অধিকাংশ স্মৃতিকথায়ই অনুপস্থিত৷ 'দয়াময়ীর কথা' আসলেই একটা সম্পূর্ণ আলাদা আলোচনার যোগ্য বই৷
অফ টপিক:: গুরগাঁওতে একটা বইয়ের দোকানে যেতাম৷ সেখানকার মালিক নাকি 'আদার সাইড অব সাইলেন্স'এর রানামামা'র ভাগ্নে৷ ঊর্বশী নাকি তাঁরও কাজিন৷ :) সত্যি না ঢপ জানি না অবশ্য৷ তবে আমাকে কিছু ইন্টারেস্টিং গল্প শুনিয়েছিলেন৷
বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন করালেন বৈজয়ন্ত। একেবারে বই জীয়ন্ত। সৃষ্টিশীল বাঙালি জাতির দেশভাগের ইতিহাস সম্পর্কে ইচ্ছাকৃত এক বিস্মৃতি ও ঔদাসীন্য রয়েছে। হ্যাঁ, ইতিহাস অবশ্যই ট্রমাগ্রস্ততার ইতিহাস, সরে সরে কথা বলার ইতিহাস। এ আলোচনা থেকে কিন্তু ক্রমমুক্তির আশ্বাস মিলল। সবটুকু যন্ত্রণা খোঁজার এবং শাপমুক্তির ইঙ্গিত বোধহয় মিলতে চলেছে।
ReplyDeleteboijayanter lekhaa parhe upalabdhi halo lyaad kaaTiye exuNi baiTaa kine phelaa uchi`t.
ReplyDeletemaathaar madhye baasaa baa`ndhaa anek prashno guli Jen ei upanyaase paaThe kichhuTaa mukti paabe.
byaktigata satyer mukhokhi daa`nrhiye aatmopolabdhir deepti, ta`tsaha antarleen gaarhha bishhaad- ei saaraa`tsaare , nitaantanta swalpa parisare grantha tinaTinaTike paaThaker ekaanta upalabdhite ekatre baa`ndhaa- ei durooha kaajaTi anaayaas susampanna e'lekhaay. dhanyabaad boijayanta.
ReplyDeleteindraaNee